বাণিজ্যিক ব্যাংক (Commercial Bank) এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা প্রধানত ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক লেনদেন পরিচালনা করে, যাতে তারা জনসাধারণ থেকে আমানত সংগ্রহ এবং ঋণ প্রদান করে। এটি দেশের অর্থনীতির অঙ্গ হিসেবে কাজ করে, এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত, এই ধরনের ব্যাংকগুলি মুনাফার উদ্দেশ্যে কাজ করে এবং তাদের আয়ের প্রধান উৎস ঋণের সুদ এবং অন্যান্য ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে আসে। এই ব্যাংকগুলি দেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রবাহিত অর্থ এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বাণিজ্যিক ব্যাংক একদিকে ব্যবসা পরিচালনা করে, অন্যদিকে জনগণের জন্য আর্থিক সেবা সরবরাহ করে থাকে। এটি বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয় প্রকল্প এবং ঋণ পরিষেবা প্রদান করে থাকে, যাতে সাধারণ মানুষ তাদের অর্থ নিরাপদে রাখতে পারে এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি ঋণ নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের মৌলিক কার্যাবলি
বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য হলো জনগণের সঞ্চিত অর্থ গ্রহণ এবং তা থেকে উপার্জিত সুদের মাধ্যমে লাভ অর্জন করা। এই ব্যাংকগুলি প্রধানত তিনটি কাজে নিয়োজিত থাকে:
- অমানত গ্রহণ – বাণিজ্যিক ব্যাংক জনগণের অর্থ সঞ্চয় হিসেবে গ্রহণ করে।
- ঋণ প্রদান – গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ প্রদান করে থাকে, যা পরবর্তীতে সুদসহ ফেরত আসবে।
- বিভিন্ন সেবামূলক কার্যাবলি – যেমন চেক, ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডার, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ইত্যাদি প্রদান করে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রকারভেদ
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সাধারণত তিনটি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যায়:
১. রাষ্ট্রয়াত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক (State-Owned Commercial Bank)
রাষ্ট্রয়াত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের মালিকানা সরকারের হাতে থাকে। এই ব্যাংকগুলি রাষ্ট্রের পক্ষে পরিচালিত হয় এবং সরকারের পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের উদাহরণ।
২. বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক (Private Commercial Bank)
এ ধরনের ব্যাংকগুলি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বা বেসরকারি সংস্থার অধীনে পরিচালিত হয়। এই ব্যাংকগুলি লাভের জন্য কাজ করে এবং তাদের লাভের একটি বড় অংশ আসে ঋণ সুদ ও বিভিন্ন সেবা থেকে। বাংলাদেশে ৪৩টি বেসরকারি ব্যাংক রয়েছে।
৩. বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক (Foreign Commercial Bank)
বিদেশি ব্যাংকগুলি এমন ব্যাংক যা অন্যান্য দেশ থেকে আসা এবং স্থানীয় অর্থনৈতিক লেনদেন ও ব্যবসা করার জন্য শাখা স্থাপন করেছে। এগুলির বাংলাদেশে কিছু শাখা রয়েছে, যেমন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, সিটিব্যাংক, হ্যাবিব ব্যাংক, ভারতীয় স্টেট ব্যাংক ইত্যাদি।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হলো:
- তালিকাভুক্ত ব্যাংক: যে সমস্ত ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্ত ও নির্দেশনা অনুসরণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদস্য হয়ে থাকে, সেগুলো তালিকাভুক্ত ব্যাংক হিসেবে গণ্য হয়।
- সঞ্চয় ও ঋণ: বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানত গ্রহণ করে এবং ঋণ প্রদান করে, যা সাধারণত একটি অর্থনৈতিক চক্র সৃষ্টি করে।
- আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম: বাণিজ্যিক ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের লেনদেনের মাধ্যমে অর্থের ঘূর্ণন সৃষ্টি করে, যেমন চেক, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি।
- সেবামূলক কাজ: ব্যাংকগুলি জনগণের জন্য সেবামূলক কাজ করে থাকে, যেমন অর্থ স্থানান্তর, ঋণ পরামর্শ প্রদান, এবং অন্যান্য আর্থিক সেবা।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাজ কি? (What is the Work of Commercial Bank?)
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির প্রধান কাজ হলো ঋণ প্রদান এবং সঞ্চয় সংগ্রহ করা। তবে, তারা বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক কাজেও অংশগ্রহণ করে। এই কাজগুলো মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত:
- সাধারণ কার্যাবলি: ঋণ প্রদান এবং আমানত গ্রহণ এই কার্যাবলির মধ্যে পড়ে।
- সেবামূলক কার্যাবলি: যেমন গ্রাহকদের জন্য ব্যাংকিং পরিষেবা প্রদান, যেমন চেক, ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডার ইত্যাদি।
- প্রতিনিধিত্বমূলক কার্যাবলি: বাণিজ্যিক ব্যাংকরা অনেক সময় গ্রাহকদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে থাকে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎস
বাণিজ্যিক ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎসগুলো হচ্ছে:
- ঋণের সুদ: ব্যাংকগুলি ঋণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের আয়ের একটি বড় অংশ অর্জন করে থাকে। সাধারণত এই সুদের হার ব্যাংকগুলি নিজেদের প্রয়োজন এবং বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারণ করে।
- বিনিয়োগ: ব্যাংকগুলি শেয়ারবাজার, সরকারি বন্ড, সিকিউরিটি এবং অন্যান্য লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে থাকে।
- সেবা প্রদান: ব্যাংকগুলি বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান করে যেমন, চেক, ব্যাংক ড্রাফট, এবং পে-অর্ডার ইত্যাদি, এবং সেজন্য কমিশন গ্রহণ করে।
- লকার ভাড়া: ব্যাংকগুলি গ্রাহকদের মূল্যবান জিনিস যেমন অলংকার, স্বর্ণ, এবং দামী কাগজপত্র সংরক্ষণের জন্য লকার সেবা প্রদান করে, এবং এই সেবার জন্য ব্যাংক চার্জ নেয়।
- বৈদেশিক লেনদেন: আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করার জন্য ব্যাংকগুলি বিশেষ ধরনের সেবা যেমন Letter of Credit (LC) প্রদান করে, যার মাধ্যমে তারা কমিশন অর্জন করে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের আর্থসামাজিক দায়িত্ব
বাণিজ্যিক ব্যাংক শুধু অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে না, বরং সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে সাহায্য করে। তারা বিভিন্ন আর্থসামাজিক প্রকল্পে অংশ নেয় যেমন কৃষকরা ক্ষুদ্র ঋণ পাওয়া, গ্রামাঞ্চলে শিল্প-উদ্যোগের প্রসার, শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এই ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।
উপসংহার
বাণিজ্যিক ব্যাংক, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে। এটি জনসাধারণের জন্য সঞ্চয় এবং ঋণ সুবিধা প্রদান করার পাশাপাশি বিভিন্ন সেবামূলক কাজেও অংশগ্রহণ করে। এর মাধ্যমে দেশের আর্থিক অবস্থা সুরক্ষিত এবং শক্তিশালী থাকে, এবং ব্যাংকগুলোর আয়ের প্রধান উৎস যেমন ঋণের সুদ, বিনিয়োগ, সেবামূলক কার্যাবলি, এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতা নিশ্চিত করে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আর্থসামাজিক দায়িত্ব পালন করাও তাদের কাজের অংশ, যেখানে তারা জনগণের কল্যাণে সাহায্য করে এবং দেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় অবদান রাখে।